জলবসন্ত বা চিকেন পক্স (chicken pox)
উন্মেষকাল (অর্থাৎ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার পর থেকে প্রথম লক্ষণ প্রকাশ হওয়ার মাঝের সময়কাল) – ১০-২১ দিন
সংক্রামক কাল (অর্থাৎ যে সময়টাতে একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্যের মধ্যে ছড়ায়) – আক্রান্ত ব্যক্তির গায়ে র্যাশ বা গুটি দেখা যাওয়ার আগের ১-২ দিন এটি সবচেয়ে বেশি অন্যের শরীরে ছড়ায়। তবে গুটি শুকিয়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটি সংক্রামক পর্যায়ে থাকে। র্যাশ হওয়ার ৫-৬ দিন পর থেকে এটি শুকাতে শুরু করে।
লক্ষণসমূহঃ
- প্রথমদিকে কিছুটা খারাপ লাগা বোধ হবে, শরীরে র্যাশ বা গুটি দেখা দিবে ও জ্বর হবে
- র্যাশ প্রথমে বিন্দু আকারে থাকে, ১-২ দিনের মধ্যে সেগুলো লাল হয়ে ফুলে উঠে তরল পদার্থ পূর্ণ ফোসকাতে পরিণত হয়। এগুলো ধীরে ধীরে শুকনো মামড়ীতে রূপান্তরিত হয় এবং খসে পড়ে। বুক, পিঠ, মাথা অথবা ঘাড়ে প্রথমে দাগ দেখতে পাওয়া যায় এবং পরে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। গুরুতরভাবে সংক্রামিত না হলে এসব দাগের কোনো ক্ষতচিহ্ন থাকে না।
যা করা উচিতঃ
- জলবসন্ত হয়েছে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এবং শিশু মারাত্মক অসুস্থ না হলে শিশুকে ডাক্তার বা জরুরী বিভাগে নেয়ার প্রয়োজন নেই।
- শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি খেতে দিন।
- জ্বর ও অসুস্থতাবোধ কমানোর জন্য প্যারাসিটামল বা আইবোপ্রোফেন জাতীয় ঔষধ খেতে দিন।
- গোসল করালে, পাতলা আরামদায়ক কাপড় পড়ালে ও ক্যালামাইন লোশন গায়ে মাখালে চুলকানি কিছুটা কমতে পারে।
শিশু যাতে দাগগুলোতে না চুলকায় সেদিকে খেয়াল রাখবেন কারণ চুলকানোর কারণে ক্ষত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শিশুকে চুলকানো থেকে বিরত রাখা কঠিন হবে, তাই তার প্রশংসা করুন ও প্রচুর উৎসাহ দিন। টেলিভিশন দেখায় ব্যস্ত রাখা চুলকানো থেকে মনোযোগ সরানোর জন্য একটি ভালো পন্থা। জলবসন্ততে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে তার স্কুলকে অবহিত করুন যাতে অন্যান্য শিশুরা সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকিতে না থাকে।
গর্ভবতী বা গর্ভবতী হতে পারেন এমন মহিলার কাছ থেকে শিশুকে দূরে রাখুন। জলবসন্তে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে শিশু যদি কোনো গর্ভবতী মহিলার সংস্পর্শে এসে থাকে, তাহলে সেই মহিলাকে সংক্রামিত হওয়া সম্পর্কে অবহিত করুন এবং এ বিষয়ে ডাক্তার অথবা নার্সের পরামর্শ নিতে বলুন। আপনি আপনার অভিজ্ঞতা অন্যান্য মা দের সাথে মায়া ভয়েসে ভাগও করতে পারেন। পূর্বে জলবসন্তে আক্রান্ত হননি এমন মহিলা গর্ভাবস্থায় সংক্রামিত হলে গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন অথবা শিশু জলবসন্ত নিয়ে জন্ম গ্রহণ করতে পারে।
হাম
উন্মেষকালঃ ৭-১২ দিন
সংক্রামক কালঃ র্যাশ দৃশ্যমান হওয়ার পূর্বের ৪ দিন থেকে র্যাশ শুকিয়ে যাওয়ার পরের ৪ দিন পর্যন্ত।
লক্ষণসমূহঃ
- প্রাথমিক পর্যায়ে খুব সর্দি, কাশি থাকে, সেই সাথে চোখ থাকে জলপূর্ণ।
- ধীরে ধীরে জ্বর বাড়তে থাকবে ও শিশু ক্রমাগত অসুস্থ হতে থাকবে।
- আক্রান্ত হওয়ার ৩য় অথবা ৪র্থ দিনে শিশুর শরীরে র্যাশ দেখা দিবে। র্যাশ হবে লাল রঙের ও কিছুটা ফোলা থাকবে। এগুলো ফুসকুড়ির মতো হতে পারে, কিন্তু চুলকানি থাকবে না। কানের পিছনে এই র্যাশ প্রথমে দেখা যায়, পরে মুখ, ঘাড়ে এবং পরবর্তীতে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
অসুস্থতা সাধারনত ১ সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
জলবসন্ত, জার্মান মিজেলস, মাম্পস থেকেও হাম অনেক বেশি ক্ষতিকর। এমএমআর টিকা হাম প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সুরক্ষা প্রদান করে। হাম জটিল পর্যায়ে চলে গেলে নিউমোনিয়া অথবা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
যা করা উচিতঃ
- শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল খাবার ও পানি খেতে দিন। গরম পানি পানে, কাশি কমাতে সাহায্য করবে। সেই সাথে শিশু যাতে বিশ্রাম নেয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- জ্বর ও অসুস্থতাবোধ কমানোর জন্য প্যারাসিটামল বা আইবোপ্রোফেন জাতীয় ঔষধ খেতে দিন।
- ঠোঁটকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য ঠোঁটে ভ্যাসলিন লাগিয়ে দিন।
- চোখের পাতায় এবং কোনে যদি ময়লা জমে, তাহলে উষ্ণ পানি দিয়ে মৃদুভাবে চোখ মুছে দিন।
- শিশু যদি শ্বাসকষ্টে ভোগে, কাশির পরিমাণ বেড়ে যায় বা তন্দ্রাচ্ছন্নতা দেখা যায়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
মাম্পস
উন্মেষকালঃ ১৪-২৪ দিন
সংক্রামক কালঃ অসুস্থতা বোধ করার পূর্বের কয়েকদিন থেকে ফোলা না কমা পর্যন্ত।
লক্ষণসমূহঃ
- অসুস্থতাবোধ হওয়া
- উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর
- কানের সামনের দিক ও চোয়ালের নিচের অংশ ফুলে যাওয়া। প্রথমে একদিক থেকে ফুলে যাওয়া শুরু হয়, পরে ধীরে ধীরে অন্য অংশে ফোলা দেখা যায় ( সবসময় নাও হতে পারে)।
- খাবার চিবানোতে অসুবিধা দেখা দেয়া।
১ সপ্তাহের মধ্যে শিশুর মুখ সাধারণ অবস্থায় ফিরে আসবে। মাম্পস অনেক সময় ছেলেদের শুক্রাশয় এবং মেয়েদের ডিম্বাশয়কে আক্রান্ত করে থাকে। কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এটা বিরল, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রায়ই হয়ে থাকে। যদি আপনার শিশুর অণ্ডকোষ ফোলা মনে হয় অথবা ব্যাথা থাকে, তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
যা করা উচিতঃ
- ফুলে যাওয়া গ্রন্থির ব্যাথা কমানোর জন্য শিশুকে প্যারাসিটামল বা আইবোপ্রোফেন জাতীয় ঔষধ খেতে দিন। সঠিক পরিমাণ জানার জন্য ঔষধের মোড়ক দেখুন।
- শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি জাতীয় খাবার দিন। তবে ফলের জুস দিবেন না কারণ এধরণের খাবার লালা প্রবাহের সৃষ্টি করে যা শিশুর ব্যাথাকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।
- পেট ব্যাথা, বেগুনি রঙের ছোট ছোট র্যাশ, লাল দাগ বা কালশিটে দাগ দেখা না দিলে কিংবা শিশু মারাত্মক অসুস্থ না হলে ডাক্তারে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
পার্ভোভাইরাস বি১৯ (ফিফ্থ ডিজিজ বা স্ল্যাপ্ড চিক্স ডিজিজ)
উন্মেষকালঃ ১-২০ দিন
সংক্রামক কালঃ র্যাশ দৃশ্যমান হওয়ার পূর্বের কয়েকদিন। শিশুদের মধ্যে র্যাশ দৃশ্যমান হয়ে গেলে তা আর সংক্রামক পর্যায়ে থাকে না।
লক্ষণসমূহঃ
- প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বর ও সর্দি থাকে।
- চড় দিলে গাল যেভাবে লাল হয়, তেমনি গালে উজ্জ্বল লাল রঙের র্যাশ দেখা দেয়।
- পরবর্তী ২ থেকে ৪ দিনের মধ্যে মধ্যশরীর ও হাত পা তে র্যাশ ছড়িয়ে পড়ে।
- স্ফেরোসাইটোসিস, সিকল সেল ডিজিজের মতো রক্তজনিত রোগে আক্রান্ত শিশু এতে আক্রান্ত হলে আরো বেশি রক্তশূণ্যতায় ভুগতে পারে। সেক্ষেত্রে, তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত।
যা করা উচিতঃ
- শিশু যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও বিশ্রাম গ্রহণ করে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- জ্বর ও অসুস্থতাবোধ কমানোর জন্য প্যারাসিটামল বা আইবোপ্রোফেন জাতীয় ঔষধ খেতে দিন।
- গর্ভবতী বা গর্ভবতী হতে পারেন এমন মহিলা যদি সংক্রামিত হন বা শরীরে র্যাশ দেখা দেয় তাহলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
রুবেলা (জার্মান হাম)
উন্মেষকালঃ ১৫-২০ দিন
সংক্রামক কালঃ র্যাশ দৃশ্যমান হওয়ার পূর্বের ১ সপ্তাহ থেকে র্যাশ শুকিয়ে যাওয়ার পরের অন্তত ৫ দিন পর্যন্ত।
লক্ষণসমূহঃ
- প্রাথমিক পর্যায়ে হালকা সর্দি থাকে।
- ১-২ দিনের মধ্যে শরীরে র্যাশ দেখা যায়। প্রথমে মুখে পরে সারা শরীরে র্যাশ ছড়িয়ে পড়ে। দাগগুলো মসৃণ থাকে, পাতলা বা উজ্জ্বল ত্বকে দাগ হালকা গোলাপি রঙের হয়।
- ঘাড়ের পিছনের দিকের গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে।
- শিশুরা সাধারণত অসুস্থতা বোধ করে না।
- নিশ্চিতভাবে রুবেলা রোগ নির্ণয় করা কঠিন ।
যা করা উচিতঃ
- শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি খেতে দিন।
গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে (৪ মাস) আছেন বা গর্ভবতী হতে পারেন এমন মহিলার কাছ থেকে শিশুকে দূরে রাখুন। রুবেলায় আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে শিশু যদি কোনো গর্ভবতী মহিলার সংস্পর্শে এসে থাকে, তাহলে সেই মহিলাকে রুবেলাতে সংক্রামিত হওয়া সম্পর্কে অবহিত করুন এবং এ বিষয়ে ডাক্তার অথবা নার্সের পরামর্শ নিতে বলুন।
হুপিং কাশি
উন্মেষকালঃ ৫-২১ দিন
সংক্রামক কালঃ অসুস্থতার প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশিত হওয়া থেকে শুরু করে কাশি শুরু হওয়ার পরবর্তী ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত। যদি অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ঔষধ প্রদান করা হয়, তাহলে চিকিৎসা শুরুর ৫ দিন পর্যন্ত সংক্রামক কাল স্থায়ী হয়। আরোগ্য লাভের জন্য লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ঔষধ প্রদান করতে হয়।
লক্ষণসমূহঃ
- প্রাথমিক পর্যায়ে সর্দি, কাশি থাকে। কাশি ধীরে ধীরে খারাপ অবস্থা ধারণ করে।
- ২ সপ্তাহ পরে কাশি অনেক বেড়ে যায়, যা ক্লান্তিকর হয় ও শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি করে।
- ৬ মাসের কম বয়সী শিশু মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কাশি শুরু হওয়ার আগেই তাদের শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে যেতে পারে বা শ্বাসের সমস্যার কারণে মুখমন্ডল নীল হয়ে যেতে পারে।
- শিশুর গলায় খাবার আটকে যেতে পারে ও বমি করতে পারে।
- কাশির পর শ্বাস টেনে নেওয়ার সময় হুপিং জাতীয় শব্দ শোনা যেতে পারে। এটি কখনো কখনো হয় কিন্তু সবসময় হয় না।
- কাশি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে এবং ৩ মাস পর্যন্ত স্থায়ী থাকতে পারে।
- হুপিং কাশি নিরাময়ের সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হলো টিকা প্রদান করা।
- যদি শিশুর কাশি না কমে বরং বাড়তে থাকে এবং কাশির পরিমাণ বেড়ে খারাপ অবস্থা হয়, তাহলে শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
অন্যান্য শিশুর সুরক্ষার খাতিরে আপনার শিশুর হুপিং কাশি হয়েছে কি না তা জানা অত্যন্ত জরুরী। শিশুর কীভাবে যত্ন নিবেন সে ব্যাপারে জানার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন। হুপিং কাশিতে সংক্রামিত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছেন, এমন ব্যক্তিদের থেকে আক্রান্ত শিশুকে দূরে রাখুন।
আরো তথ্য
মারাত্মক অসুস্থতার লক্ষণ সনাক্তকরণ
বাচ্চার জ্বর খুব বেশি হলে কী করবেন