কোন নবজাতক বা শিশুর কোন কারণে শ্বাসক্রিয়া এবং হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেলে কিভাবে জীবনরক্ষা করতে হবে, সে ব্যপারে বিস্তারিত তথ্য সকলের জানা থাকা উচিত। সে কারণে প্রত্যেক বাবা-মার প্রাথমিক চিকিৎসার উপর প্রশিক্ষণ থাকা ভাল। প্রশিক্ষণ থাকলে প্রয়োজনের সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া যায় এবং যা যা করণীয় সেসব সঠিক ভাবে করা যায়।
১। প্রথমেই নিশ্চিত হয়ে নিন, স্থানটি কতটা নিরাপদ
যে স্থানটিতে এই কাজটি করবেন, ভাল করে দেখে নিন সেখান দিয়ে গাড়ী চলে কিনা, কোন বৈদ্যুতিক তার বা এরকম ঝুঁকিপূর্ণ কোন কিছু আছে কিনা
২। শিশুর অবস্থা নিরূপণ করুন
পায়ের তালুতে আচড় দিয়ে, ঘাড়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বা জোরে ডাক দিয়ে শিশুর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করুন
এসব করতে যেয়ে এমন ভাবে শিশুকে ঝাকাবেন না, যাতে ঘাড়ে আঘাত পেতে পারে
৩। ক। শিশু যদি এসবে সাড়া দেয়
যে ভাবে আছে তাকে সেভাবেই থাকতে দিন (যদি না সে কোন বিপদজনক অবস্থায় থাকে)
শিশুর অবস্থা নিরূপণ করুন, প্রয়োজনে কারো সাহায্য প্রার্থনা করুন
একটু পর পর শিশুর অবস্থা পরীক্ষা করুন
৩।খ। যদি শিশু কোন প্রতিক্রিয়া না দেখায়
চীৎকার করে অন্যের সাহায্য প্রার্থনা করুন, তারপর –
শিশুর বয়স যদি এক বৎসরের কম হয়
ঘাড় এবং মাথা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করুন। ঘাড় যেন কোন দিকে ভাজ হয়ে না থাকে, ঘাড় আর মাথাকে শরীর বরাবর এক রেখায় রাখুন
একই সঙ্গে শিশুর চিবুকের নিচে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিয়ে চিবুককে উপরের দিকে তুলে ধরুন। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, আঙ্গুলের চাপ যেন চিবুকের হাড়ের উপর হয়, তার নিচের নরম অংশে না পড়ে, নরম অংশে চাপ পরলে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হবে
শিশুর বয়স যদি এক বৎসরের বেশি হয়
শিশুকে যে অবস্থাতে পাওয়া গেছে সে অবস্থাতেই চিবুককে উপরের দিকে তুলে ধরে, ঘাড় এবং মাথাকে পিছন দিকে একটু হেলিয়ে রাখুন। এতে শ্বাসনালী পুরোপুরি খুলে থাকে, শ্বাস প্রশ্বাস সহজ হয়
এটা করার জন্য এক হাত দিয়ে শিশুর কপালের উপর সামান্য চাপ দিন, অন্য হাত দিয়ে চিবিক তুলে ধরুন।খেয়াল রাখতে হবে, আঙ্গুলের চাপ যেন চিবুকের নিচের নরম অংশে না পড়ে, তাতে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হবে
এই কাজ গুলো শিশুকে চিৎ করে শুইয়ে করাতে পারলে ভাল হয়। তেমন অসুবিধা না হলে শিশুকে চিৎ করে সোজা ভাবে শুইয়ে দিন
যদি মনে হয় ঘাড়ে কোন আঘাত আছে তবে সাবধানতার সাথে ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরাবেন, যতক্ষন না শ্বাসনালী পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়।
৪। শ্বাসনালী পুরোপুরি উন্মুক্ত অবস্থায় রেখে, শিশুর মুখের কাছে আপনার মুখ নিয়ে, তার শ্বাসের শব্দ শোনার বা অনুভব করার চেষ্টা করুন, বুকের উঠা নামা লক্ষ করুন
বুকের দিকে খেয়াল করুন, সামান্য হলেও উঠা নামা করছে কিনা লক্ষ করুন
শিশুর মুখ এবং নাকের কাছে আপনার কান নিয়ে শ্বাসের শব্দ শোনার চেষ্টা করুন
শিশুর মুখের কাছে আপনার মুখ নিয়ে এমন ভাবে রাখুন যাতে আপনার চিবুকে তার শ্বাস ফেলাটা অনুভব করতে পারেন
শিশু শ্বাস নিচ্ছে নাকি নিচ্ছেনা, আপনার দেখা, শোনা এবং অনুভবের মধ্য দিয়ে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে সিদ্ধান্তে আসুন।
৫।ক। যদি শিশু শ্বাস নিতে থাকে
পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিন
নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ করতে থাকুন
৫।খ। যদি শিশুর শ্বাস বন্ধ হয়ে থাকে বা অনিয়মিত হয়ে থাকে
শিশুর মুখের মধ্যে যদি কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়ে থাকে, সেটা সরিয়ে দিন
প্রাথমিক ভাবে মুখে মুখ লাগিয়ে পাঁচবার তার মুখের ভিতরে জোরে শ্বাস ঢুকিয়ে দিন
এটা করার সময় শিশু কেশে উঠে কিনা বা তার গলার ভিতরে ঘড় ঘড় শব্দ হয় কিনা খেয়াল করুন
এক বৎসরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ‘মুখে মুখ লাগিয়ে কৃত্রিম শ্বাস’ দেয়ার পদ্ধতি
শিশুর মাথাকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রেখে চিবুক তুলে ধরুন
বুকভরে শ্বাস নিন, আপনার মুখ দিয়ে শিশুর নাক-মুখ এমন ভাবে আবৃত করুন যেন কোন ফাক না থাকে। একবারে নাক-মুখ দুটোই আবৃত না করা গেলে, যে কোন একটা হাত দিয়ে চেপে ধরে অন্যটাকে আপনার মুখ দিয়ে আবৃত করুন
এবার জোরে জোরে পাঁচবার শিশুর নাক-মুখ দিয়ে আপনার প্রশ্বাস, শিশুর শ্বাসনালীতে ঢুকিয়ে দিন। প্রতিবার যেন এটি কমপক্ষে ১.৫ সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হয়। প্রতিবার শিশুর শ্বাসনালীতে বাতাস ঢুকানো এতটা জোরে হতে হবে, যেন শিশুর বুক কিছুটা হলেও ফুলে উঠে
এবার আপনার মুখ সরিয়ে নিন। শিশুর ঘাড় এবং মাথাকে পিছন দিকে একটু হেলিয়ে দিয়ে, চিবুক উচু করে – এ অবস্থায় ধরে রাখুন, তার বুকের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া বাতাস বের হবার কারনে শিশুর ফুলে উঠা বুক কিছুটা নেমে আসে কিনা খেয়াল করুন
তারপর একই প্রক্রিয়ায় আবার শিশুর শ্বাসনালীতে বাতাস ঢুকিয়ে দিন, এভাবে একটু পর পর পাঁচ মিনিট পর্যন্ত করতে থাকুন
এক বৎসরের বেশি বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ‘মুখে মুখ লাগিয়ে কৃত্রিম শ্বাস’ দেয়ার পদ্ধতি
শিশুর ঘাড় এবং মাথাকে পিছন দিকে একটু হেলিয়ে দিয়ে, চিবুক উচু করে তুলে ধরুন
শিশুর কপালে হাতের তালু রেখে, সে হাতের তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে শিশুর নাক চেপে ধরুন
শিশুর মুখটা একটু খুলে দিন, কিন্তু চিবুক উচু করাই থাকবে
বুকভরে শ্বাস নিন, আপনার ঠোট দিয়ে শিশুর মুখ এমন ভাবে আবৃত করুন যেন কোন ফাক না থাকে
এবার জোরে জোরে পাঁচবার শিশুর নাক-মুখ দিয়ে আপনার প্রশ্বাস, শিশুর শ্বাসনালীতে ঢুকিয়ে দিন। প্রতিবার যেন এটি কমপক্ষে ১.৫ সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হয় এবং শিশুর বুক কিছুটা হলেও ফুলে উঠে
এবার আপনার মুখ সরিয়ে নিন। শিশুর ঘাড় এবং মাথাকে পিছন দিকে একটু হেলিয়ে দিয়ে, চিবুক উচু করে – এ অবস্থায় ধরে রাখুন, তার বুকের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া বাতাস বের হবার কারনে শিশুর ফুলে উঠা বুক কিছুটা নেমে আসে কিনা খেয়াল করুন
তারপর একই প্রক্রিয়ায় আবার শিশুর শ্বাসনালীতে বাতাস ঢুকিয়ে দিন, এভাবে একটু পর পর পাঁচ মিনিট পর্যন্ত করতে থাকুন। খেয়াল করুন স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাসের সময় যেমনটা হয়, সেভাবে শিশুর বুক উঠা নামা করছে কিনা
৫।গ। এরপরেও যদি শিশুর শ্বাস ফেলার কোন চিহ্ন না দেখা যায়, তবে শিশুর শ্বাসনালীতে কোন প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা সেটা দেখতে হবে। সেক্ষেত্রে,
শিশুর মুখ খুলে ভিতরে কোন কিছু আটকে আছে কিনা পরীক্ষা করুন। কিছু থাকলে বের করে ফেলুন। ভালমত না দেখে শিশুর মুখে আঙ্গুল বা অন্য কোন কিছু ঢুকাবেন না
শিশুর ঘাড় এবং মাথা পিছন দিকে একটু হেলিয়ে রাখতে হবে, কিন্তু ঘাড় পিছন দিকে বেশি বেঁকে আছে কিনা সেটা লক্ষ করুন
পাঁচবার পর্যন্ত এভাবে শিশুর শ্বাস প্রশ্বাস চালু করার চেষ্টা করুন। তারপরও না হলে ‘বুকে চাপ দেয়া’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চেষ্টা করতে হবে
৬। প্রানের কোন চিহ্ন আছে কিনা, খুজে দেখুন
শিশুর শরীরে প্রানের কোন চিহ্ন আছে কিনা, ১০ সেকেন্ডের মধ্যে খুজে দেখুন। যেমন, কোন নড়াচড়া, কাশি, স্বাভাবিক শ্বাস বা কিছুক্ষন পর পর হেচকির মত আটকে যাওয়া শ্বাস
৭।ক। যদি ১০ সেকেন্ডের মধ্যে প্রানের কোন চিহ্ন খুজে পান
জীবন রক্ষাকারী এই কৃত্রিম শ্বাস চালিয়ে যেতে থাকুন, যতক্ষন না শিশুর স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস চালু হচ্ছে
শিশু যদি তখনও অজ্ঞান থাকে, একদিকে কাত করে শুইয়ে দিন
একটু পর পর শিশুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকুন
৭।খ। যদি ১০ সেকেন্ডের মধ্যে প্রানের কোন চিহ্ন খুজে না পান বা আপনি নিশ্চিত হতে পারছে না, সেক্ষেত্রে
‘বুকে চাপ দেয়া’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করুন
মুখে মুখ লাগিয়ে কৃত্রিম শ্বাস এবং ‘বুকে চাপ দেয়া’ দুটোই পর্যায়ক্রমে চালিয়ে যেতে থাকুন
‘বুকে চাপ দেয়া’ কিভাবে করবেন
চাপ দেয়ার স্থান যেন বুকই হয়, পেট যেন না হয় প্রথমে তা নিশ্চিত হয়ে নিন। তার জন্য বুকের সামনে নিচের দিকে যেখানে দুই পাশের একদম শেষের পাজরের হাড়টি মিলিত হয়েছে সে জায়গাটি খুজে বের করুন।তার থেকে এক আঙুল উপরে বুকের মাঝখানের চওড়া হাড়টিতে (breast bone) চাপ দিন
এমনভাবে চাপ দিন যেন বুক এক তৃতীয়াংশের মত ডেবে যায়। ঘন ঘন চাপ দিতে হবে যেন তা মিনিটে ১০০ এর মত হয়। ৩০ টা চাপ দেয়ার পর শিশুর ঘাড় এবং মাথা পিছন দিকে একটু হেলিয়ে দিয়ে, চিবুক উচিয়ে ধরে মুখে মুখ লাগিয়ে দুইবার কৃত্রিম শ্বাস দিন, তারপর আবার বুকে চাপ দিতে থাকুন
প্রতি ৩০ টা চাপ দেয়ার পর, দুইবার কৃত্রিম শ্বাস – এভাবে চালিয়ে যেতে থাকুন
এক বৎসরের কম এবং এক বৎসরের বেশি বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ‘বুকে চাপ দেয়া’র পদ্ধতিতে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।
এক বৎসরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ‘বুকে চাপ দেয়া’ দেয়ার পদ্ধতি
এক বৎসরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে হাতের দুই আঙুল দিয়ে বুকে চাপ দিতে হবে। পুরো হাত বা দুই হাত ব্যবহার করা যাবে না
এক বৎসরের বেশি বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ‘বুকে চাপ দেয়া’ দেয়ার পদ্ধতি
বুকের মাঝখানের চওড়া হাড়ের (breast bone) নিচের এক তৃতীয়াংশের উপর হাতের তালুর নিচের অংশ দিয়ে চাপ দিন
হাতের আঙ্গুলগুলো উপরের দিকে তুলে রাখুন যাতে বুকের পাজরে চাপ না পড়ে
আপনি শিশুর বুক বরাবর উপরের দিকে সোজা হয়ে অবস্থান নিন, আপনার হাত শিশুর বুকের উপর লম্বালম্বি ভাবে থাকবে যাতে চাপটি খাড়া ভাবে নিচের দিকে পড়ে এবং শিশুর বুক এক তৃতীয়াংশের মতো ডেবে যায়
বাচ্চা যদি বড় হয় বা আপনি যদি আকারে ছোট হোন, সেক্ষেত্রে আপনি দুই হাত ব্যবহার করতে পারেন। এক হাতের আঙ্গুলের ভিতরে অন্য হাতের আঙ্গুল ঢুকিয়ে দুই হাত জড়ো করে শিশুর বুকে চাপ দিন, এতে পাজরের হাড়ে আঙ্গুলের চাপ পড়বে না
৮। জীবন রক্ষাকারী এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে থাকুন, যতক্ষণ না –
শিশুর মধ্যে প্রানের চিহ্ন দেখা যায়
সাহায্যকারী দল পৌছায়
অথবা আপনার শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়